আশ্বিনের এক শারদপ্রাতের আখ্যান
by published
"জাগো তুমি জাগো....."
ভোর ৪ টে। পাড়ার পুজোপ্যান্ডেলে বেজে উঠলো আবালবৃদ্ধবনিতার শরীরে শিহরণ জাগানো সেই অপ্রতিম সঙ্গীত; দেবী দুর্গতিনাশিনীর আগমনী বার্তা! গানের প্রথম পংক্তিতেই চোখ খুললো এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মনও যেন আদেশ দিলো "আর একদম বিছানায় থাকা নয়; আজ যে সকলের চিরাকাঙ্খিত মহালয়া!"। বেশ টের পেলাম, পুরো এক সপ্তাহের হাড়ভাঙা ধকল সহ্য করা আমার কায়া এই প্রথমবার ছুটির দিনেও আরামের বদলে শারদীয় সুখ - সান্নিধ্য পেতে ব্যাকুল। উপর্যুপরি দূর্গামায়ের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ আরাধনাস্থল মহানগরী কলকাতায় এই মাহেন্দ্রক্ষণে উপস্থিত থেকেও তার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকা আসন্ন পুজোর উন্মাদক ঘ্রাণ উপভোগের লোভ সামলানোর মতো কঠিন কাজ আমার দ্বারা অন্তত হবেনা! সুতরাং ভেবে দেখলাম এই লোভনীয় সুযোগের সদ্ব্যবহার করাটাই বাঞ্ছনীয়; যা করতে আমি আবার বরাবরই এক পায়ে খাড়া! জানালা খুলে বাইরে তাকাতেই মহালয়ার সুন্দর শুদ্ধ ভোরের মনমোহনী রূপ যেন আমায় হাতছানি দিয়ে ডাক দিল। সেই ডাকের প্রবল আকর্ষণ অগ্রাহ্য করা যে আমার আমিতে অন্যথা সুপ্ত পুজো - প্রেমী বাঙালি হৃদয়ের পক্ষে অসম্ভব!
অতএব আধঘন্টার মধ্যে তৈরী হয়ে পরিষ্কার কাপড়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরলাম, শারদোৎসব আরম্ভের আনন্দে মাতোয়ারা কলকাতাকে প্রকৃতভাবে চিনে নেওয়ার আশায়। পথে নেমেই মনটা অকৃত্রিম তৃপ্তিতে ভরে উঠলো; বহুদিনের জমাটবাঁধা হৃদিতৃষ্ণা মেটানোর এক অজানা আকাঙ্খা যেন মাথাচাড়া দিল। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ত একঘেয়েমির চাপে সংকুচিত হয়ে রইলেও আমার এই প্রাপ্তবয়ষ্ক সত্তার মধ্যে কোথাও একটা লুক্কায়িত শিশুমনের সারল্য আজও পুজো নামক এক আহ্লাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে; দিন গুনে যায় ভুবনমোহিনী মায়ের শান্তিপ্রদায়িনি আবাহনীর।
কল্লোলিনী কলকাতা আজ মায়ের মর্তে আবির্ভাবের সুখবরে আপ্লুত। প্রতি বছরের মত এবছর ও কল্যাণময়ী সর্বাসুরবিনাশার অভ্যাগমের পথ চেয়ে বসে থাকা মর্তবাসীদের দীর্ঘ এক আকুল অপেক্ষার অবসান হলো আজ অবশেষে! দিব্য অনুভব করলাম আমাদের প্রাণের শহরের পরতে পরতে পুজোর নির্ভেজাল আবেগ ঠিক যেন সতেজ ঘাসের উপর স্নিগ্ধ শিউলি ফুলের মত ছড়িয়ে রয়েছে। কি শান্ত ও নির্মল এই ভোর...! এ শহর যে জানে সময়োপযোগী আনন্দ-লয়ে মেতে উৎসবের স্রোতে গা ভাসাতে! হাতে চিরন্তন মাটির ভাঁড়ের চা ও চোখে অসীম ঔৎসুক্য নিয়ে শরৎকালীন কলকাতাকে আস্বাদন করতে গিয়ে আজ আবারও নতুন করে আমি কলকাতার প্রবল প্রেমে পড়লাম।
আমার মহালয়ার এই পূণ্য ঊষাকালীন সুখ উপভোগ উপাখ্যানের শুভারম্ভ হলো বাবুঘাটে হাজার - হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষের নিজেদের পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে তর্পণকার্য দর্শনের মধ্য দিয়ে । আকাশে পূর্বদিক হতে উদীয়মান সূর্যদেবের রক্তিম আভা, প্রেক্ষাপটে বহমান স্রোতস্বিনী গঙ্গার মৃদু - মন্থর গতিনিঃসৃত চাপা ধ্বনিকে ছাপিয়ে বিভিন্ন স্বরে পবিত্র মন্ত্রোচ্চারণ ও সাথে ধুপ - ধুনোর উগ্র সুবাস; সবমিলিয়ে অতুলনীয় কিছু মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইলাম।
এরপর মনে এক গাঢ় ভালোলাগার আবেশ নিয়ে হাজির হলাম দূর্গামায়ের বিশ্ববিখ্যাত মৃন্ময়ী রূপের বৃহত্তর নির্মাণকেন্দ্র কুমোরটুলিতে, যেখানে বহুকাল হতে গড়ে ওঠা "পটুয়াপাড়ার" অলিতে-গলিতে প্রতিমা গঠনরত মৃৎশিল্পীদের আশ্চর্য দক্ষতার কথা সর্বজনবিদিত। অপার বিস্ময়ে মূর্তিগুলির উপর অপার্থিব সুন্দর কারিগরি নিরীক্ষণ হেতু কতক্ষণ যে থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম প্রায় প্রতিটি অস্থায়ী শিল্পী শিবিরের সামনে, তা নিজেরই খেয়াল নেই! প্রতিটি মৃৎশিল্পী যেন তাদের অন্তরে বর্তমান কোনো না কোনো এক স্বতন্ত্র অজ্ঞাত কাহিনী শিল্পের মাধ্যমে কল্পনাচালিত জাদুকাঠিসম অঙ্গুলির দ্বারা প্রকাশের আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে সারিসারি কাঠামোর উপর। মহিষাসুরমর্দিনী মা ও তাঁর সন্তানদের সেই জাগতিক ভুবনভুলানো রূপ প্রত্যক্ষ করে আমার চক্ষু সার্থক হলো আজ; হৃদয় হয়ে উঠলো মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ।
মহালয়ার এই শুভ শারদপ্রাতের স্মৃতি আমার কাছে চিরকাল যে কতটা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে, তা হয়ত বলাই বাহুল্য। আর হ্যাঁ! যেই মানুষটা সর্বক্ষণ পাশে থেকে আমার সৌন্দর্য-পিপাসু সত্তাকে উপঢৌকন হিসেবে এই অপূর্ব অভিজ্ঞতা দ্বারা সমৃদ্ধ করলো, তাকে যথার্থরূপে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের ভাষা আমার জানা নেই। স্মৃতির রাজকীয় মণিকোঠায় যত্ন করে সাজিয়ে রাখার মত আরেকটি মহামূল্যবান রত্নের আমদানি হলো আজ, পরবর্তীকালে যার প্রত্যেকবারের রোমন্থনে আমার ঠোঁটে যে এক অনাবিল হাসি ফুটে উঠবে; তা আমি নিশ্চিত!
বেলা হয়ে আসাতে যখন ফেরার পথ ধরলাম, আকাশে পুঞ্জীভূত মেঘের ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে আমার রন্ধ্র - রন্ধ্র তখনও যেন উপলব্ধি করে চলেছে ভাবী উৎসবপ্রীতির অকপট সেই উচ্ছাস:
"বাজলো তোমার আলোর বেণু, মাতলো যে ভুবন
আজ প্রভাতে সে সুর শুনে খুলে দিনু মন।।
অন্তরে যা লুকিয়ে রাজে
অরুণবীণায় সে সুর বাজে—
এই আনন্দযজ্ঞে সবার মধুর আমন্ত্রণ।।
আজ সমীরণ আলোয় পাগল নবীন সুরের বীণায়,
আজ শরতের আকাশবীণা গানের মালা বিলায়।
তোমায় হারা জীবন মম
তোমারই আলোয় নিরুপম—
ভোরের পাখি ওঠে গাহি তোমারই বন্দন।।"